অরণ্যকাণ্ড হলো রামায়ণের তৃতীয় অধ্যায়, যেখানে রাম, সীতা, ও লক্ষ্মণের বনবাসের কাহিনি এবং বিভিন্ন ঘটনার বিবরণ বর্ণিত হয়েছে। এটি মূলত তাঁদের বনবাসের সময়কার অভিজ্ঞতা ও ঘটনাগুলো নিয়ে রচিত। অরণ্যকাণ্ডের মূল বিষয়বস্তু হলো তাদের বনবাসের সময়ের দুঃখ-দুর্দশা, রাক্ষসদের সঙ্গে সংঘর্ষ, এবং রাবণের দ্বারা সীতাহরণের কাহিনি।
বনবাসের সূচনা: নতুন পথে যাত্রা
অযোধ্যা থেকে বনবাসে রওনা হয়েছিলেন রাম, সীতা এবং লক্ষ্মণ। রাজা দশরথের আদেশ মেনে রাম সসম্মানে রাজত্ব ছেড়ে বনবাসে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। চিত্রকূট নামের এক সুন্দর স্থানে তাঁরা আশ্রয় নেন।
চিত্রকূটে প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য তাঁদের মন ভরিয়ে তোলে, কিন্তু অযোধ্যার রাজা দশরথের মৃত্যুসংবাদ তাঁদের শোকে ভেঙে দেয়। ভারত, রামের ছোট ভাই, রামের কাছে এসে রাজসিংহাসনে বসতে অনুরোধ করেন। রাম তা প্রত্যাখ্যান করেন। ভারত তাঁর পাদুকা নিয়ে অযোধ্যায় ফিরে যান এবং সেই পাদুকাকেই রাজত্বের প্রতীক হিসেবে স্থাপন করেন।
দণ্ডক অরণ্যে প্রবেশ: অজানা বিপদের দিকে যাত্রা
এরপর রাম, সীতা, ও লক্ষ্মণ দণ্ডক অরণ্যের দিকে রওনা হন। দণ্ডক অরণ্য গভীর এবং ভয়ংকর; এখানে বাস করত নানা রকম রাক্ষস, যারা ঋষি-মুনিদের কষ্ট দিত। রাম তাঁদের সুরক্ষার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন।
বনের মধ্যে তাঁরা বিভিন্ন ঋষি-মুনির সঙ্গে দেখা করেন এবং তাঁদের কাছ থেকে আশীর্বাদ নেন। বনের প্রকৃতির মাঝে থেকেও শান্তি তাঁদের জন্য ছিল দূর। তাঁরা প্রতিদিনই নতুন নতুন বিপদের মুখোমুখি হতেন।
শূর্পণখার প্রতিশোধ
দণ্ডক অরণ্যে একদিন দেখা হয় শূর্পণখা নামের এক রাক্ষসীর সঙ্গে। সে রামকে দেখে মোহিত হয়ে পড়ে এবং তাঁকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। রাম শূর্পণখাকে বলেন যে তিনি বিবাহিত, তাই তিনি তাঁর ছোট ভাই লক্ষ্মণের সঙ্গে কথা বলতে বলেন।
লক্ষ্মণও শূর্পণখার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। এতে শূর্পণখা অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে সীতাকে আক্রমণ করতে যায়। রক্ষা করার জন্য লক্ষ্মণ শূর্পণখার নাক ও কান কেটে দেন। রক্তাক্ত শূর্পণখা ছুটে যায় তাঁর ভাই রাবণের কাছে।
রাবণের ষড়যন্ত্র ও সীতাহরণ
শূর্পণখার অপমানের প্রতিশোধ নিতে রাবণ এক চতুর পরিকল্পনা করে। সে মারিচ নামক এক রাক্ষসকে সোনার হরিণের রূপ ধারণ করে রামের আশ্রমে পাঠায়। হরিণটি ছিল এত সুন্দর যে সীতা মুগ্ধ হয়ে যান। তিনি রামকে অনুরোধ করেন হরিণটি ধরে আনতে।
রাম হরিণটির পেছনে ছুটলে, মারিচ তার কণ্ঠে রামের সাহায্যের আওয়াজ তুলে চিৎকার করে। সীতা উদ্বিগ্ন হয়ে লক্ষ্মণকে রামের খোঁজে পাঠান। লক্ষ্মণ যাওয়ার আগে আশ্রমের চারদিকে একটি রক্ষা-বৃত্ত (লক্ষ্মণ রেখা) টেনে দেন এবং সীতাকে ওই রেখা অতিক্রম না করতে বলেন।
রাম ও লক্ষ্মণ না থাকার সুযোগে রাবণ সন্ন্যাসীর ছদ্মবেশে এসে সীতার কাছে ভিক্ষা চায়। সীতা সেই রক্ষা-বৃত্ত অতিক্রম করলে, রাবণ তাঁকে অপহরণ করে লঙ্কায় নিয়ে যায়।
জটায়ুর বীরত্ব
রাবণ যখন আকাশপথে সীতাকে নিয়ে যাচ্ছিল, তখন জটায়ু নামের এক বৃদ্ধ পাখি তাঁদের পথ রোধ করে। জটায়ু সাহসিকতার সঙ্গে রাবণের বিরুদ্ধে লড়াই করে সীতাকে বাঁচানোর চেষ্টা করে। কিন্তু রাবণ জটায়ুকে মারাত্মকভাবে আহত করে এবং পালিয়ে যায়।
রাম ও লক্ষ্মণ জটায়ুকে মৃতপ্রায় অবস্থায় খুঁজে পান। মৃত্যুর আগে জটায়ু তাঁদের রাবণের ষড়যন্ত্র এবং সীতার অপহরণের কথা জানান।
শবরীর আতিথ্য
জটায়ুর মৃত্যুতে ব্যথিত রাম ও লক্ষ্মণ শবরী নামক এক বৃদ্ধা ভক্তের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। শবরী বহুদিন ধরে রামের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। তিনি তাঁদের আতিথ্য করেন এবং রামের প্রতি তাঁর গভীর ভক্তি ও নিষ্ঠা প্রকাশ করেন।
শবরীর নির্দেশে রাম ও লক্ষ্মণ কিষ্কিন্ধ্যার দিকে যাত্রা করেন, যেখানে তাঁদের ভবিষ্যতের সঙ্গী হনুমান এবং বানররাজ সুগ্রীবের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়।
উপসংহার
অরণ্যকাণ্ডের প্রতিটি অধ্যায় আমাদের সাহস, ত্যাগ, প্রেম, এবং প্রতিশোধের চমৎকার উদাহরণ দেয়। রামের বনবাস শুধু দুঃখ-কষ্টের কাহিনি নয়, এটি এক মহান যাত্রার সূচনা, যেখানে ধর্ম ও সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি এক অসম লড়াইয়ের পথে এগিয়ে যান।
অরণ্যকাণ্ড শেষ হয় সীতার অপহরণ এবং রামের প্রতিজ্ঞার মধ্য দিয়ে। এই অধ্যায়টি রামায়ণের মূল গল্পকে একটি নতুন মোড় দেয়, যা শেষ পর্যন্ত রাম-রাবণের মহাযুদ্ধে পরিণত হয়।
0 মন্তব্যসমূহ